দিনটা ছিল ২ রা নভেম্বর, শনিবার। আগের দিন ১লা নভেম্বর শুক্রবার ভোরে মসজিদে নববিতে ফজরের নামাজে ইমামতির জন্য দাঁড়ানো মাত্রই বসরার গভর্নর হযরত মুগীরা বিন শুরাহ রা: এর মদিনাস্থ পারসিক দাস ফিরোজ আবু লুলু বিষাক্ত ছুরি দিয়ে এক এক করে পর পর ছয়টি আঘাত হানে হযরত ওমর রা: এর পেটে ও তলপেটে। তাঁর নাড়ী ভুড়ি বেরিয়ে যায় সেই আঘাতে।
সেদিনই দুপুরের পরে হযরত ওমর রা: কে একটু দুধ পান করতে দেয়া হলে সেই দুধও হজম ছাড়াই বের হয়ে আসে। তা দেখে সকলেই বুঝে নেন, এ যাত্রা আর খলিফাকে বাঁচানো সম্ভবপর নয়।
খলিফা নিজেও সেটা বুঝে গেছেন। এখন অপেক্ষা কেবল মালাকুল মওতের জন্য। পরদিন শনিবার হযরত ওমর রা: পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরকে কাছে ডেকে নিলেন। আব্দুল্লাহ পিতার মুখের কাছে মাথাটা একটু এগিয়ে নিলে হযরত ওমর রা: অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুললেন।
কি বলেছেন তিনি? সেটা বলার আগে আরও একটা ঘটনা বলে নেই।
ঘটনাস্থল মদিনা শহর থেকে শ দুয়েক মাইল দুরে সিরিয়ামুখী যাওয়া ৬৫৬ মাইল লম্বা প্রাচীন রাস্তার পাশে এক বেদুঈন পল্লীতে।
সময়কালটা সম্ভবত ৬৩৬-৩৭ খৃষ্টাব্দের দিকে হবে। খলিফা ওমর প্রায়ই মদিনা ছেড়ে রাজ্যের আনাচে কানাচে চলে যেতেন সাধারণ মানুষের খোজ খবর নেয়া ও নিজ চোখে তাদের অবস্থা দেখার জন্য। এরকমই একটা সফরে তিনি এসেছেন এই এলাকায়, সফরসঙ্গী হযরত আলী রা: একটু দুরে কিছু লোকের সাথে কথা বলছিলেন।
এমন সময় তিনি দেখলেন সিরিয়া অভিমুখে চলে যাওয়া পথের পাশে খাটানো একটি তাঁবুর পাশে রাস্তার উপরে এক বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন। কৌতুহলি হয়ে ওমর রা: বুড়ির পাশে থামলেন। তার কাছে জানতে চাইলেন তিনি কেন রাস্তার পাশে একাকী বসে আছেন?
বুড়ি জীবনেও ওমর রা: কে দেখেন নি, তাঁর নামটাই শুনেছেন কেবল। এক আগন্তকের অযাচিত প্রশ্নে বড় নির্লিপ্ততা ও বিরক্তির সাথে বুড়ি বলে উঠলেন;
- শুনেছি আমিরুল মু'মিনীন ওমর আজ এ পথে যাবেন, তার সাথে আমার দেখা করার খুবই দরকার, তাই রাস্তার পাশে তাঁবু খাটিয়ে বসে আছি।
হযরত ওমর রা: হাঁটু গেড়ে বৃদ্ধার পাশে বসলেন। খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন;
- আচ্ছা বুড়ি মা, আমিরুল মু'মিনীন ওমর কেমন লোক?
- ঐ বদ লোকটার কথা আর জানতে চেওনা বাপু, ওর কথা শুনে তোমার কি কাজ? তুমি বরং তোমার কাজে যাও।
- ওমা, সে কি কথা! তুমি খলিফাকে বদলোক বলছো?
- বদলোক বলবো না? তুমিই বলো বাছা, কত কষ্টে দিন পার করছি অথচ আজ পর্যন্ত খলিফার নিকট থেকে একটা কানাকড়িও সাহায্য পেলাম না!
বুড়ির কথা শুনে হযরত ওমর ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠলেন। কোমল কন্ঠে, যেন অনেকটা খলিফাকে এই বুড়ির অভিযোগ থেকে ডিফেন্ড করতে বা বাঁচাতেই বলে উঠলেন;
- মা, তুমি তো খলিফা থেকে অনেক দূরে থাকো, তিনি হয়তো তোমার এই কষ্টের খবরই পান নি।
- দূরে থাকার কারণে তিনি যদি আমার খবরই না নিতে পারেন, তা হলে তাকে খলিফা হতে বলেছে কে?
ক্ষোভ আর অনুযোগ মেশানো কন্ঠে বুড়ি এক ঝটকায় বলে গেলেন কথাগুলো। হজরত ওমর রা: এর কপালে এবারে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। নীরব, বাকহীন হয়ে তিনি ভাবনার গভীরে ডুবে গেলেন।
তাই তো, ইসলামি রাজ্যের আনাচে কানাচে এরকম কত অসহায়, দু:স্থ ও অভাবগ্রস্থ মানুষ না জানি পড়ে রয়েছেন, যাদের খবর তিনি নিতে পারেন নি! এদের খবরই যদি তিনি নিতে না পারেন তা হলে তাদের খলিফা হতে গেলেন কেন?
হযরত ওমরের মনোজগতে তখন নীরবে নিভৃতে বয়ে চলেছে এক ঝড়। পাশে বসা বুড়ির সেদিকে কোন খেয়ালই নেই! তিনি বসে আছেন কখনও আমিরুল মু'মিনীন ওমর রা: এই পথে আসেন, তাকে আজ ধরতেই হবে, সে অপেক্ষায়।
ওদিকে হযরত আলি রা: অনতিদুরে লোকজনের সাথে কথা শেষ করে এগিয়ে এলেন ওমর রা: এর খোঁজে। রাস্তার পাশে এক বুড়ির পাশ্বে আমিরুল মু'মিনীনকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। হযরত ওমর রা: এর সেদিকে খেয়ালই নেই। তিনি ডুবে আছেন গভীর এক ভাবনার জগতে! হযরত আলি রা: কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং আনমনা হয়ে বসে থাকা হযরত ওমর রা: এর মনযোগ আকর্ষণে সালাম দিলেন;
- আসসালামু আলাইকুম ইয়া আমিরুল মু'মিনীন।
হঠাৎ করেই হযরত ওমর রা: এর সম্বিৎ ফিরে এলো যেন। তিনি সালামের জবাব দিলেন। কিন্তু তাঁর পাশে বসে থাকা সেই বুড়ি তা শুনে ফেলেছেন। বুড়ি মহিলা বিষ্মিত হয়ে জানতে চাইলেন;
- আমিরুল মুমিনীন? আ আনতা আমিরুল মু'মিনীন ওমার? (তুমিই কি খলিফা ওমর?)
- হাঁ মা, আমিই তোমাদের হতভাগা খলিফা ওমর। হযরত ওমর রা: এর সকুন্ঠ জবাব।
এবারে বুড়ি লজ্জিত হলেন, ভয়ও পেলেন। আলি রা: আগা মাথা না বুঝলেও কিছু একটা আঁচ করতে পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগলেন। বুড়ি মহিলা হযরত ওমর রা: এর দিকে বিব্রত ও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালেন যা হযরত ওমর রা: এর নজর এড়ালো না।
এর পরে হযরত ওমর রা: অনেক্ষণ সময় কাটালেন সেই বৃদ্ধার সাথে, তাকে আশ্বস্থ করলেন। তার অনুযোগ, অভাব অভিযোগের কথা শুনলেন। তাকে রাষ্ট্র থেকে পেনশনের ব্যবস্থা করে দিলেন।
কিন্তু তার ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত অতিবাহিত হওয়া বিগত দিনে রাষ্ট্র থেকে এই বুড়ির পাওনাগুলোর কি হবে? তিনি বসে বসে একটা হিসেব করলেন সেখানে বসেই। বুড়ি মহিলাকেও সেই হিসেবে শামিল করলেন, অংশ নিলেন হযরত আলি'ও।
হিসেব নিকেশ করে দেখা গেল মোটামুটি ২৫টি স্বর্ণমুদ্রা হলে বুড়ির পাওনা পরিশোধ হয়। তিনি তার হাতে পচিশটি স্বর্ণমুদ্রা ধরিয়ে দিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে আশাতিরিক্ত পেয়ে বুড়িও যারপরনাই খুশি। কিন্তু হযরত ওমরা রা: এতটুকুতেই সন্তুষ্ঠ থাকতে পারলেন না।
তিনি বুড়িকে অনুরোধ করলেন, তার ওপর অর্থাৎ আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর রা: এর উপরে বুড়ির যে আর কোনো দাবি নেই, সে কথাটা আলি রা: এর সামনে ঘোষণা দিতে, চাইলে তিনি লিখেও দিতে পারেন।
বুড়ি সানন্দচিত্তে একটা চমড়ার উপরে এরকম না দাবী নামা লেখায় টিপ মারলেন। হযরত ওমর রা: কে আশ্বস্থ করলেন যে, তিনি কাল কেয়মাতের মাঠে খলিফার বিরুদ্ধে কোনো দাবী তুলবেন না।
এক অখ্যাত বৃদ্ধার কাছ থেকে পাওয়া এই শিক্ষা খলিফা ওমরকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, এর পরে তিনি প্রায়ই বলতেন, আল্লাহর কসম, ফোরাতের তীরে একটা কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায়, আমার ভয় হয়, কাল কেয়ামতের মাঠে আমাকে তার জন্যও জবাবদিহী করতে হবে ! এ কথা বলে তিনি কাঁদতেন!
সেই ভয় তাঁর কাটেনি আজও, এই মৃত্যুশয্যাতেও। তিনি পুত্র আব্দুল্রাহ রা: কে বললেন দ্রুত হিসেব করে দেখতে, ক্ষমতারোহনের দিন থেকে একজন খলিফা হিসেবে তিনি কি পরিমাণ অর্থ ভাতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন? পরিমান যাই হোক না কেন, মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব ওমর রা: এর সম্পত্তি বিক্রি করে যেন সেই অর্থ পুরোটাই বায়তুল মাল-এ জমা দিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি জানেন না, খলিফা হিসেবে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পেছেন কি না। অতএব তিনি তার প্রাপ্য ভাতাও নেবেন না এই ভয়ে যে, যদি তার দ্বারা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি হয়ে থাকে, তা হলে এই ভাতা তার জন্য বৈধ বিবেচিত হবে না।
পরদিন ৩রা নভেম্বর, রবিবার খলিফা ইন্তেকাল করলেন। তাঁর সেই অসিয়ত সহসাই পালন করা হয়েছিল। দীর্ঘ একটি দশক সময়কালে খলিফা হিসেবে নেয়া ভাতা আটষট্টি হাজার দিরহাম রাষ্ট্রিয় কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছিল।
ঘটনাটা জানার পর থেকে ভেবে হয়রান হচ্ছি, আমাদের সাড়ে সাত কোটি কিংবা বারো কোটি বা ষোলো কোটি জনতার কাছে কার যে কতটা দায় রয়ে গেছে, তার হিসেব কে রাখে?
রাঘব বোয়ালদের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমরা নিজেদের কথাই বলি। সংসারে কতভাবে জেনে বা না জেনে কতজনের কত হক্ব নষ্ট করেছি, বুঝে বা না বুঝে কতজনের উপরে কত জুলুম করেছি, জুলুমের উপলক্ষ্য হয়েছি বা হতে দিয়েছি! আজ এই বয়সে এসে তাদের হাতে সেই বুড়ির মত করে ক'টা স্বর্ণমুদ্রা ধরিয়ে দেবো, সে সামর্থ যেসব বুড়োদের নেই, তাদের কি হবে? প্রশ্নটা কি একটু কঠিন হয়ে গেল?প্রশ্নটা কি একটু কঠিন হয়ে গেল?
**************************************
দিনটা ছিল ২ রা নভেম্বর, শনিবার। আগের দিন ১লা নভেম্বর শুক্রবার ভোরে মসজিদে নববিতে ফজরের নামাজে ইমামতির জন্য দাঁড়ানো মাত্রই বসরার গভর্নর হযরত মুগীরা বিন শুরাহ রা: এর মদিনাস্থ পারসিক দাস ফিরোজ আবু লুলু বিষাক্ত ছুরি দিয়ে এক এক করে পর পর ছয়টি আঘাত হানে হযরত ওমর রা: এর পেটে ও তলপেটে। তাঁর নাড়ী ভুড়ি বেরিয়ে যায় সেই আঘাতে।
সেদিনই দুপুরের পরে হযরত ওমর রা: কে একটু দুধ পান করতে দেয়া হলে সেই দুধও হজম ছাড়াই বের হয়ে আসে। তা দেখে সকলেই বুঝে নেন, এ যাত্রা আর খলিফাকে বাঁচানো সম্ভবপর নয়।
খলিফা নিজেও সেটা বুঝে গেছেন। এখন অপেক্ষা কেবল মালাকুল মওতের জন্য। পরদিন শনিবার হযরত ওমর রা: পুত্র প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমরকে কাছে ডেকে নিলেন। আব্দুল্লাহ পিতার মুখের কাছে মাথাটা একটু এগিয়ে নিলে হযরত ওমর রা: অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুললেন।
কি বলেছেন তিনি? সেটা বলার আগে আরও একটা ঘটনা বলে নেই।
ঘটনাস্থল মদিনা শহর থেকে শ দুয়েক মাইল দুরে সিরিয়ামুখী যাওয়া ৬৫৬ মাইল লম্বা প্রাচীন রাস্তার পাশে এক বেদুঈন পল্লীতে।
সময়কালটা সম্ভবত ৬৩৬-৩৭ খৃষ্টাব্দের দিকে হবে। খলিফা ওমর প্রায়ই মদিনা ছেড়ে রাজ্যের আনাচে কানাচে চলে যেতেন সাধারণ মানুষের খোজ খবর নেয়া ও নিজ চোখে তাদের অবস্থা দেখার জন্য। এরকমই একটা সফরে তিনি এসেছেন এই এলাকায়, সফরসঙ্গী হযরত আলী রা: একটু দুরে কিছু লোকের সাথে কথা বলছিলেন।
এমন সময় তিনি দেখলেন সিরিয়া অভিমুখে চলে যাওয়া পথের পাশে খাটানো একটি তাঁবুর পাশে রাস্তার উপরে এক বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন। কৌতুহলি হয়ে ওমর রা: বুড়ির পাশে থামলেন। তার কাছে জানতে চাইলেন তিনি কেন রাস্তার পাশে একাকী বসে আছেন?
বুড়ি জীবনেও ওমর রা: কে দেখেন নি, তাঁর নামটাই শুনেছেন কেবল। এক আগন্তকের অযাচিত প্রশ্নে বড় নির্লিপ্ততা ও বিরক্তির সাথে বুড়ি বলে উঠলেন;
- শুনেছি আমিরুল মু'মিনীন ওমর আজ এ পথে যাবেন, তার সাথে আমার দেখা করার খুবই দরকার, তাই রাস্তার পাশে তাঁবু খাটিয়ে বসে আছি।
হযরত ওমর রা: হাঁটু গেড়ে বৃদ্ধার পাশে বসলেন। খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন;
- আচ্ছা বুড়ি মা, আমিরুল মু'মিনীন ওমর কেমন লোক?
- ঐ বদ লোকটার কথা আর জানতে চেওনা বাপু, ওর কথা শুনে তোমার কি কাজ? তুমি বরং তোমার কাজে যাও।
- ওমা, সে কি কথা! তুমি খলিফাকে বদলোক বলছো?
- বদলোক বলবো না? তুমিই বলো বাছা, কত কষ্টে দিন পার করছি অথচ আজ পর্যন্ত খলিফার নিকট থেকে একটা কানাকড়িও সাহায্য পেলাম না!
বুড়ির কথা শুনে হযরত ওমর ভেতরে ভেতরে আঁতকে উঠলেন। কোমল কন্ঠে, যেন অনেকটা খলিফাকে এই বুড়ির অভিযোগ থেকে ডিফেন্ড করতে বা বাঁচাতেই বলে উঠলেন;
- মা, তুমি তো খলিফা থেকে অনেক দূরে থাকো, তিনি হয়তো তোমার এই কষ্টের খবরই পান নি।
- দূরে থাকার কারণে তিনি যদি আমার খবরই না নিতে পারেন, তা হলে তাকে খলিফা হতে বলেছে কে?
ক্ষোভ আর অনুযোগ মেশানো কন্ঠে বুড়ি এক ঝটকায় বলে গেলেন কথাগুলো। হজরত ওমর রা: এর কপালে এবারে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। নীরব, বাকহীন হয়ে তিনি ভাবনার গভীরে ডুবে গেলেন।
তাই তো, ইসলামি রাজ্যের আনাচে কানাচে এরকম কত অসহায়, দু:স্থ ও অভাবগ্রস্থ মানুষ না জানি পড়ে রয়েছেন, যাদের খবর তিনি নিতে পারেন নি! এদের খবরই যদি তিনি নিতে না পারেন তা হলে তাদের খলিফা হতে গেলেন কেন?
হযরত ওমরের মনোজগতে তখন নীরবে নিভৃতে বয়ে চলেছে এক ঝড়। পাশে বসা বুড়ির সেদিকে কোন খেয়ালই নেই! তিনি বসে আছেন কখনও আমিরুল মু'মিনীন ওমর রা: এই পথে আসেন, তাকে আজ ধরতেই হবে, সে অপেক্ষায়।
ওদিকে হযরত আলি রা: অনতিদুরে লোকজনের সাথে কথা শেষ করে এগিয়ে এলেন ওমর রা: এর খোঁজে। রাস্তার পাশে এক বুড়ির পাশ্বে আমিরুল মু'মিনীনকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এলেন। হযরত ওমর রা: এর সেদিকে খেয়ালই নেই। তিনি ডুবে আছেন গভীর এক ভাবনার জগতে! হযরত আলি রা: কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং আনমনা হয়ে বসে থাকা হযরত ওমর রা: এর মনযোগ আকর্ষণে সালাম দিলেন;
- আসসালামু আলাইকুম ইয়া আমিরুল মু'মিনীন।
হঠাৎ করেই হযরত ওমর রা: এর সম্বিৎ ফিরে এলো যেন। তিনি সালামের জবাব দিলেন। কিন্তু তাঁর পাশে বসে থাকা সেই বুড়ি তা শুনে ফেলেছেন। বুড়ি মহিলা বিষ্মিত হয়ে জানতে চাইলেন;
- আমিরুল মুমিনীন? আ আনতা আমিরুল মু'মিনীন ওমার? (তুমিই কি খলিফা ওমর?)
- হাঁ মা, আমিই তোমাদের হতভাগা খলিফা ওমর। হযরত ওমর রা: এর সকুন্ঠ জবাব।
এবারে বুড়ি লজ্জিত হলেন, ভয়ও পেলেন। আলি রা: আগা মাথা না বুঝলেও কিছু একটা আঁচ করতে পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনতে লাগলেন। বুড়ি মহিলা হযরত ওমর রা: এর দিকে বিব্রত ও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালেন যা হযরত ওমর রা: এর নজর এড়ালো না।
এর পরে হযরত ওমর রা: অনেক্ষণ সময় কাটালেন সেই বৃদ্ধার সাথে, তাকে আশ্বস্থ করলেন। তার অনুযোগ, অভাব অভিযোগের কথা শুনলেন। তাকে রাষ্ট্র থেকে পেনশনের ব্যবস্থা করে দিলেন।
কিন্তু তার ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত অতিবাহিত হওয়া বিগত দিনে রাষ্ট্র থেকে এই বুড়ির পাওনাগুলোর কি হবে? তিনি বসে বসে একটা হিসেব করলেন সেখানে বসেই। বুড়ি মহিলাকেও সেই হিসেবে শামিল করলেন, অংশ নিলেন হযরত আলি'ও।
হিসেব নিকেশ করে দেখা গেল মোটামুটি ২৫টি স্বর্ণমুদ্রা হলে বুড়ির পাওনা পরিশোধ হয়। তিনি তার হাতে পচিশটি স্বর্ণমুদ্রা ধরিয়ে দিলেন। অপ্রত্যাশিতভাবে আশাতিরিক্ত পেয়ে বুড়িও যারপরনাই খুশি। কিন্তু হযরত ওমরা রা: এতটুকুতেই সন্তুষ্ঠ থাকতে পারলেন না।
তিনি বুড়িকে অনুরোধ করলেন, তার ওপর অর্থাৎ আমিরুল মুমিনীন হযরত ওমর রা: এর উপরে বুড়ির যে আর কোনো দাবি নেই, সে কথাটা আলি রা: এর সামনে ঘোষণা দিতে, চাইলে তিনি লিখেও দিতে পারেন।
বুড়ি সানন্দচিত্তে একটা চমড়ার উপরে এরকম না দাবী নামা লেখায় টিপ মারলেন। হযরত ওমর রা: কে আশ্বস্থ করলেন যে, তিনি কাল কেয়মাতের মাঠে খলিফার বিরুদ্ধে কোনো দাবী তুলবেন না।
এক অখ্যাত বৃদ্ধার কাছ থেকে পাওয়া এই শিক্ষা খলিফা ওমরকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে, এর পরে তিনি প্রায়ই বলতেন, আল্লাহর কসম, ফোরাতের তীরে একটা কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায়, আমার ভয় হয়, কাল কেয়ামতের মাঠে আমাকে তার জন্যও জবাবদিহী করতে হবে ! এ কথা বলে তিনি কাঁদতেন!
সেই ভয় তাঁর কাটেনি আজও, এই মৃত্যুশয্যাতেও। তিনি পুত্র আব্দুল্রাহ রা: কে বললেন দ্রুত হিসেব করে দেখতে, ক্ষমতারোহনের দিন থেকে একজন খলিফা হিসেবে তিনি কি পরিমাণ অর্থ ভাতা হিসেবে গ্রহণ করেছেন? পরিমান যাই হোক না কেন, মৃত্যুর পর যত দ্রুত সম্ভব ওমর রা: এর সম্পত্তি বিক্রি করে যেন সেই অর্থ পুরোটাই বায়তুল মাল-এ জমা দিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি জানেন না, খলিফা হিসেবে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করতে পেছেন কি না। অতএব তিনি তার প্রাপ্য ভাতাও নেবেন না এই ভয়ে যে, যদি তার দ্বারা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি হয়ে থাকে, তা হলে এই ভাতা তার জন্য বৈধ বিবেচিত হবে না।
পরদিন ৩রা নভেম্বর, রবিবার খলিফা ইন্তেকাল করলেন। তাঁর সেই অসিয়ত সহসাই পালন করা হয়েছিল। দীর্ঘ একটি দশক সময়কালে খলিফা হিসেবে নেয়া ভাতা আটষট্টি হাজার দিরহাম রাষ্ট্রিয় কোষাগারে ফেরত দেওয়া হয়েছিল।
ঘটনাটা জানার পর থেকে ভেবে হয়রান হচ্ছি, আমাদের সাড়ে সাত কোটি কিংবা বারো কোটি বা ষোলো কোটি জনতার কাছে কার যে কতটা দায় রয়ে গেছে, তার হিসেব কে রাখে?
রাঘব বোয়ালদের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমরা নিজেদের কথাই বলি। সংসারে কতভাবে জেনে বা না জেনে কতজনের কত হক্ব নষ্ট করেছি, বুঝে বা না বুঝে কতজনের উপরে কত জুলুম করেছি, জুলুমের উপলক্ষ্য হয়েছি বা হতে দিয়েছি! আজ এই বয়সে এসে তাদের হাতে সেই বুড়ির মত করে ক'টা স্বর্ণমুদ্রা ধরিয়ে দেবো, সে সামর্থ যেসব বুড়োদের নেই, তাদের কি হবে? প্রশ্নটা কি একটু কঠিন হয়ে গেল?
Copied from Zia Ul Haque